চরম সংকটে দেশের অধিকাংশ ব্যাংকবহিভর্‚ত আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ ঋণই এখন খেলাপি। বিশেষ করে ১৫-১৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা ঋণের ৪৫ থেকে ৯৯ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
তবে সার্বিকভাবে পুরো খাতে ভালো-মন্দ মিলে ৩৩ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বড় অঙ্কের খেলাপি আছে, যা আদায় অযোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের জুনভিত্তিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
খাতসংশ্লিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি আসল চিত্র নয়। প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি, যা এ খাতের জন্য অশনিসংকেত। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশই খেলাপি। ২০২৩ সালের জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাহাড়সম অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। যার খেসারত দিতে হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরসহ পুরো আর্থিক খাতকে। পিকে হালদারের মালিকানা আছে বা ছিল- এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) খেলাপির হার ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা ৭৪৩ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এছাড়া পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা এবং আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আভিভার পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
এর বাইরে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৪১, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৯২ দশমিক ৩৭, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৪১, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪, সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ১৭, আইআইডিএফসির ৫৮ দশমিক ৬৪, হজ ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯, ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৮৬, বে লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮২ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের ৫০ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী হওয়া দরকার, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক খাতে যেভাবে সংস্কার চলছে, সেভাবে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও সংস্কার করা যেতে পারে। এছাড়া কোনো বিকল্প দেখছি না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে আদায় অযোগ্য ঋণের অঙ্ক ২১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ। এত বড় অঙ্কের আদায় অযোগ্য ঋণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকেই ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ছিল ৮ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। আর গত বছরের জুনে এই খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সামগ্রিক অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। এ কারণে ঋণ পরিশোধ কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোয় নানা ধরনের ঋণ রয়েছে, তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এত সুযোগ নেই। এ কারণেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্পেটের নিচে খেলাপি ঋণ খুঁজে বের করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সূচক সাময়িক অবনতি হলেও ভালো পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো সামনে ভালো করবে।’
এদিকে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকায়। এর আগের প্রান্তিকে যা ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। যদিও এ তিন মাসেই আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন সাড়ে ৪৮ হাজারের বেশি ব্যক্তি আমানতকারী।