২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে বাস্তবে কার্যত একটি ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারে পরিণত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনকালে বিরোধী দলগুলোর ওপর নানা দমন-পীড়ন চালিয়ে সরকারের আস্থা অর্জন করেছিল পুলিশের অনেক কর্মকর্তা। আর সেটিকে কাজে লাগিয়ে দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পুলিশের এসব কর্মকর্তা।
অভিযোগ আছে, তৎকালীন সরকারের মদদে রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পুলিশের প্রায় অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা। ঘুষ বাণিজ্য থেকে শুরু করে পুলিশের নিয়োগ, পদায়ন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মামলায় হস্তক্ষেপ, গ্রেপ্তার বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন তারা। সেই সঙ্গে ক্রসফায়ার ও মামলার ভয় দেখিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তাদের নির্দেশেই শিক্ষার্থীর ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়েছে তাদের অধস্তন পুলিশ সদস্যরা। তাদের এই চেষ্টা গত ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বহাল রাখার জন্য দলীয় কর্মীর মতো ভূমিকা পালন করেছেন এসব পুলিশ কর্মকর্তা। ছাত্র-জনতার রোষানলে টিকতে না পেরে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর পুলিশের কর্মকর্তারাই বিভিন্ন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করেছেন। চিহ্নিত হওয়া কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন পলাতক। এছাড়া তাদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন।
দুদক জানিয়েছে, বিগত দিনের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে এসব উচ্চাভিলাসী ও অপেশাদার পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। যারা গত ১৬ বছরে উচ্চাভিলাষী অপেশাদার আচরণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সদ্যবিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ নিয়ে তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেছেন বলেও প্রমাণ রয়েছে। এদের অনেকেই ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করেছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। অভিযুক্ত অর্ধ শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে তারা তৎপর হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের সম্পদের তদন্ত শুরু হয়েছে।
তালিকায় রয়েছেন, সাবেক প্রভাবশালী আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সদ্য সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও খন্দকার ফারুক হোসেন।
১৯৯১ সালে নিয়োগ পাওয়া ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজি কামরুল আহসান, আতিকুল ইসলাম ও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
১৯৯৫ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন এসবির সদ্য ওএসডি হওয়া এসবি প্রধান মো, মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজি ওয়াই এম বেলালুর রহমান, শিল্প পুলিশের প্রধান মাহবুবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদস্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, চট্টগাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম।
১৯৯৮ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৭ ব্যাচের ডিএমপির ওএসডি হওয়া কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি অপারেশন আনোয়ার হোসেন, ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার, ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আব্দুল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম।
১৯৯৯ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার মো. মাহবুব আলম, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো, মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দপ্তরের জয়দেব কুমার ভদ্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
২০০১ সালে নিয়োগ পাওয়া ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন শাহ মিজান শফিউর রহমান, মো. আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, এসএম মোস্তাক আহমেদ, জিহাদুল কবীর, মো. ইলিয়াস শরীফ, নূরে আলম মিনা, শাহ আবিদ হোসেন, মো. জামিল হাসান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার বহুল আলোচিত মো. হারুন অর রশীদ, এসবির মোহা. মনিরুজ্জামান, শ্যামল কুমার নাথ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আলমগীর কবির, মো হামিদুল আলম, ড. শামসুন্নাহার, শেখ রফিকুল ইসলাম, ড. একেএম ইকবাল হোসেন ও মো. মাসরুকুর রহমান খালেদ।
২০০৩ সালে নিয়োগ পাওয়া ২১তম ব্যাচের ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মো. মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক ও সুব্রত কুমার হালদার, শ্যামল কুমার মুখার্জী, মো সাজ্জাদুর রহমান, প্রবীর কুমার রায়, আসম মাহতাব উদ্দিন, মোহা আহমারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মো মোকতার হোসেন ও পংকজ চন্দ্র রায়।
২২তম ব্যাচের ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসান, একই ব্যাচের মোহাম্মদ জায়েদুল ইসলাম ও সঞ্জিত কুমার রায়।
২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৪ বাচের মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, ডিবি’র উপ-কমিশনার মশিউর রহমান (সদস্য সিএমপিতে বদলি), নাবিদ কামাল শৈবাল, মো. শহিদুল্লাহ, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ।
২০০৬ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৫তম ব্যাচের ঢাকার এসপি মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, পাবনার এসপি মো. আব্দুল আহাদ, ডিএমপি’র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, রাজিব আল মাসুদ, আসমা সিদ্দিকা মিলি, কাজী আশরাফুল আজিম, হায়াতুল ইসলাম খান, জসিম উদ্দিন মোল্লা ও মো. শাহজাহানসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে। এ ছাড়া মহিবুল ইসলাম খান, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে। এর বাইরেও পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও থানার অনেক ওসির নামও আছে তালিকায়।