দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার ও কালোটাকা উদ্ধারে শিগগিরই যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই মধ্যে অভিযান পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মন্ত্রণালয় ও জেলাভিত্তিক টাস্কফোর্স গঠন করে দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানের ছক করা হচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
৫ জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপরই আত্মগোপনে চলে গেছেন সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগপন্থি স্থানীয় জনপ্রতিনিরা। লম্বা সময় ধরে এলাকায় ত্রাস হিসাবে পরিচিত দলটির স্থানীয় নেতারাও প্রকাশ্যে নেই। বেগতিক অবস্থা টের পেয়ে সরকার পতনের আগে ও পরে দেশ ছাড়ার সুযোগও নিয়েছেন অনেকেই। তবে বিদায়ি সরকারের বেশিরভাগ মন্ত্রী-এমপি, সুবিধাভোগী আমলা ও ব্যবসায়ীরা দেশ ছাড়তে পারেননি। বাকিরা আত্মগোপনে। এছাড়া জীবন রক্ষার্থে আশ্রয় নেওয়া কিছুসংখ্যক আছেন সরকারি হেফাজতে। সূত্র জানায়, পলাতকদের ধরতেই অভিযানের ছক চূড়ান্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে সাবেক সচিব শাহ কামালের বাসা থেকে ৩ কোটি টাকা উদ্ধারের পর দুর্নীতিবাজদের মধ্যে অভিযান আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১-১১ এর সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। তখন আতঙ্কে দুর্নীতিবাজদের অনেকেই রাস্তায় গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার নজির আছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সারা দেশে অভিযানে নেমেছিল যৌথবাহিনী। তখন ভয়ে অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আবার অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু এবার এখনো সে ধরনের কোনো অভিযান দেখা যাচ্ছে না। খুব দ্রুত সন্ত্রাস দমন ও দুর্নীতিবাজদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালালে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরবে। তবে বিলম্বিত অভিযান, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের রক্ষার সুযোগ করে দিতে পারে।
‘সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন আর ৮ জুলাই নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট এক নয়। এবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে খোদ সরকারপ্রধান জীবন বাঁচাতে পালিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ‘গণভবন’ দখলে নিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট চালায়। থানা-পুলিশও আক্রোশের শিকার হয়। দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলে অনেক মন্ত্রী-এমপির বাড়িতে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এখনো পলাতক। সরকারি আলটিমেটাম অনুযায়ী তারা কর্মস্থলে যোগ দেননি। এরকম এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে স্থিতিশীল করতে কাজ করছে।
বিশেষ করে পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া এবং বেশ কয়েকদিন পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা নজিরবিহীন। পুলিশকে কাজে ফিরিয়ে বাহিনী পুনর্গঠনের জন্যই এবার যৌথ অভিযান এখনো শুরু করা যাচ্ছে না। তবে শিগগিরই অভিযানের পরিকল্পনা রয়েছে। অভিযান দেরিতে শুরুর আরেকটি কারণ হচ্ছে, ১-১১ এর সরকার তড়িঘড়ি অভিযান চালাতে গিয়ে রাতারাতি যাদের ধরে জেলবন্দি করে মামলা দিয়েছিল সেসব বেশিরভাগ মামলা আদালতে টেকেনি। ফলে এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান হবে ভিন্নরকম। যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যৌথবাহিনীর একটা অভিযান হতেই পারে। তবে এই অভিযানে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে সবার কাছে মেসেজ পৌঁছায় অপরাধ করলে কেউ পার পাবে না। তাহলে যৌথ অভিযান জনসমর্থন পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগের তুলনায় এবারকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গণআন্দোলন, বিদ্রোহ, বিপ্লব যাই বলেন, এর মাধ্যমে সরকারের পতন হয়েছে। এখন যারা ক্ষমতায় বসেছেন তারা সবকিছু গুছিয়ে জেলাভিত্তিক নির্দেশনাগুলো দেবেন। যৌথ অভিযান শুরু করতে দেরি হচ্ছে-এমনটা আমার মনে হয় না।
জানা গেছে, ১-১১ এর আদলে এবারও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তর ও জেলাভিত্তিক টাস্কফোর্স গঠন করা হতে পারে। টাস্কফোর্সের মূল দায়িত্বে থাকবেন সেনা সদস্যরা। এলাকাভিত্তিক বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ তাদের কাজে সহযোগিতা করবে। আর দুর্নীতিবাজদের আইনের মুখোমুখি করে সাজা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব পালন করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাই টাস্কফোর্সের অভিযানের আগেই সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানো হবে। যে কোনো দিন দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা পদত্যাগের নির্দেশনা পেতে পারেন। ইতোমধ্যেই টাস্কফোর্সের অভিযানসংক্রান্ত কাজে যুক্ত করতে বিভিন্ন বাহিনীর সৎ ও মেধাবী অফিসারদের বাছাই করে তালিকা করা হচ্ছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দরকারি সব প্রস্তুতি শেষে সরকারের তরফ থেকে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা আসতে পারে।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানান, যৌথ অভিযানের ছক চূড়ান্ত করা হচ্ছে। ১-১১ এর সরকারের আদলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যৌথ বাহিনীর একাধিক অফিস করা হবে। এ কাজে সেনাবাহিনী, প্রশাসন, দুদক, পুলিশ, র্যাব বিজিবি সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন। আর এককভাবে আইনগত পদক্ষেপ নেবে দুদক। অন্যরা সব ধরনের ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ দেবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। আগের অভিযানগুলোতে দুর্নীতিবাজরা যেমন ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেছে এবার সেই সুযোগ থাকবে না। তাই একটু বিলম্ব হলেও আটঘাট বেঁধে মাঠে নামবে। অভিযানে যারা গ্রেফতার হবেন তাদের বিরুদ্ধে সব মামলা করবে দুদক।
জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও আর্থিক খাতের অন্যতম লোপাটকারী সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে গ্রেফতার করার পর দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে-দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি, আমলা, রাজনৈতিক নেতা ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বাকিরা এখন কোথায়, তারা ধরা পড়ছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর আগ মুহূর্তেও তার কাছের মন্ত্রী-এমপিরা খবরটি জানতেন না। এ কারণে বেশিরভাগ মন্ত্রী-এমপি দেশ ছাড়তে পারেননি। তারপরও নানা কৌশলে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। দেশত্যাগের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-নারায়ণগঞ্জ ২ আসনের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু, কুষ্টিয়া ২ আসনের এমপি কামরুল আরেফিন, মানিকগঞ্জ-২ আসনের এমপি জাহিদ মালেক, ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান নিক্সন, দিনাজপুর ৬ আসনের এমপি শিবলী সাদিক, টাঙ্গাইল-৫ আসনের এমপি সানোয়ার হোসেন, নাটোর-২ আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল, ঢাকা-৫ আমনের এমপি মশিউর মোল্লা সজল, ঢাকা ১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা-১ আসনের এমপি ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, সাবেক গণশিক্ষামন্ত্রী রুমানা আলী, নোয়াখালী-২ আসনের এমপি মোর্শেদ আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের এমপি ফায়জুর রহমান, কুমিল্লা-৮ আসনের এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন ও ময়মনসিংহ-৮ আসনের মাহমুদুল হাসান সুমন। এছাড়াও দেশ ছেড়েছেন-সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, সাবেক এমপি সৈয়দ একরামুজ্জামান, আরও বেশকিছু মন্ত্রী-এমপির দেশত্যাগের গুঞ্জন থাকলেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আত্মগোপনে ও সেনা হেফাজতে থাকা যাদের নাম বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন-আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক নৌ পরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল ইসলাম চৌধুরী নওফেল, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী রাজশাহীর এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী, রাজশাহীর আলোচিত মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ও সন্দ্বীপের আলোচিত এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা। এদের মতো বেশিরভাগ মন্ত্রী-এমপি দেশত্যাগ করার সুযোগ পাননি। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হলে এরাসহ আরও অনেকেই আইনের আওতায় আসবেন বলে জানা গেছে।