অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনী দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এবং তৎপরবর্তী সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সশস্ত্র বাহিনী বরাবরের মতো মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের ছাত্র-জনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। গত কয়েক মাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতে ড. ইউনূস মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিতা নারীদের স্মরণ করেন। পরে তিনি জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ ও সাহসের কথা উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর বর্তমান ও সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল থেকে পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ে তারা দেশ সেবায় সব সময় তৎপর থাকবে।
বাংলাদেশ প্রতিবেশীসহ সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় একটি দেশ। প্রতিবেশীসহ সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধাশীল সহযোগিতার মাধ্যমে সহাবস্থানই আমাদের মূল লক্ষ্য।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসনীয় কাজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী তাদের পেশাদারিত্ব ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি ৩৬ বছর ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে। শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য নাম।
একই সঙ্গে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, যাদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ ও সাহস দেশ পুনর্গঠনে একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

এর আগে গতকাল সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত আরেকটি অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জনগণ যাতে সব ক্ষমতার মালিক হতে পারে, তেমন দেশ গড়তে চাই।
তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সব মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারও ওপরে না, আবার কেউ কারও নিচেও না– এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সম্প্রতি আমরা অর্জন করেছি, সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র-জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছেন, এর মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি।

বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সব বীর শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এ সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল প্রধান উপদেষ্টাকে সালাম জানায়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখানে রাখা দর্শনার্থীদের বইয়েও স্বাক্ষর করেন। এর আগে শিখা অনির্বাণে পৌঁছালে সেখানে তিন বাহিনীর প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে স্বাগত জানান।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সাক্ষাৎ
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন তিন বাহিনীর প্রধান। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বাসসকে জানান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতিকে তাদের নিজ নিজ বাহিনীর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন।
দিবসটি উপলক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপ্রধান। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্বের প্রতীক উল্লেখ করে মোঃ সাহাবুদ্দিন বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-পরবর্তী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকারও প্রশংসা করেন তিনি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *