ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যই হলো প্রত্যেককে তার অধিকার পরিপূর্ণভাবে দিয়ে দেওয়া। সমাজের প্রত্যেকে যদি তার প্রাপ্য অংশ পায়, তবে সেখানে কোনো রকম ঝগড়া-ফ্যাসাদ, অশান্তি ও হানাহানি থাকে না।

এ কারণে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে সবচেয়ে শান্তিময় সমাজ ছিল নবি-রাসূল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমাজ। আর তাদের প্রতিষ্ঠিত সমাজের প্রধান ভিত্তিই ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করা। এটা তাদের দায়িত্ব ছিল। আর এ দায়িত্ব নির্ধারণ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।

আল্লাহতায়ালা আল কুরআনের বহু স্থানে নবি ও রাসূলদের সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি আমার রাসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের ওপর কিতাব ও মানদণ্ড নাজিল করেছি, যাতে মানবজাতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি লোহাও নাজিল করেছি, যার মধ্যে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের অনেক কল্যাণ আছে।

এ জন্য যে, আল্লাহ জানতে চান, কে না দেখেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদের সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী। ‘সামাজিক ন্যয়বিচার’ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন-নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সৎকাজ ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও অবাধ্যতা নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের সদুপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। এছাড়া যারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে না, তাদের আল কুরআন কাফির হিসাবে আখ্যায়িত করেছে।

আল কুরআনে আরও বলা হয়েছে-ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাক্ষীরূপে তোমরা অবিচল থেক। কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদের ন্যায়বিচার না করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার করবে। এটা তাকওয়ার অধিকতর কাছাকাছি। আর আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ নিশ্চয়ই তার খবর রাখেন।

এ আয়াতের তাফসিরে ‘আল্লামা হাফিয ইবন কাছীর (রহ.) বলেন, আল্লাহতায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদের ন্যায়ের অবিচল থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং তারা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুত হয়ে ডানে বা বামে যেতে পারবে না। তাদের আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো নিন্দুকের নিন্দা প্রভাবিত করবে না। কোনো বাধাদানকারী বিরত রাখতে পারবে না। আর তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। যে বান্দা তার স্রষ্টার হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে, মানসিক প্রশান্তিতে জীবন কাটানো তার জন্য অনেক সহজ হয়।

পরিবারের প্রত্যেকে যদি অন্যের হক ঠিকমতো আদায় করে, তাহলে সে পরিবার সুখ ও শান্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। একইভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেকে যদি অন্যের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন থাকে, কেউ কাউকে যদি বঞ্চিত ও জুলুম না করে, তাহলে সে সমাজ ও রাষ্ট্র শান্তিময় সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর এর বিপরীত হলে সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন-মানুষের স্বহস্ত উপার্জনের দরুন জল-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো হবে, যাতে তারা বিরত হয়। এ জন্য বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধান অনুযায়ী ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।

আল্লাহতায়ালা পুরো পৃথিবী পরিচালনা করেন। পৃথিবীর কল্যাণের জন্য তিনি সব কিছুর সুন্দর ব্যবস্থাপনা করেন। তিনি বলেন-তিনি সব কিছুর ব্যবস্থাপনা করেন আর তাঁর আয়াতগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেন। সুতরাং তাঁরই নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী পৃথিবী চললে সেখানে অবশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এছাড়া মানব রচিত কোনো পন্থায়, অন্যের ওপর জুলুম করে, জোর করে অন্যের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের সময় মানবজাতি বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। এদের কেউ কেউ নিজেদের দেবতার বংশধর মনে করত, আবার কেউ কেউ মনে করত তাদের শরীরে রাজ-রাজাদের রক্তধারা প্রবাহিত। এ কারণে তারা নিজেদের অন্য থেকে শ্রেয় মনে করত। আবার কাউকে মনে করত আল্লাহর মস্তক থেকে সৃষ্ট। সে জন্য অন্যরা তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করত।

অন্যদিকে কাউকে ভাবত আল্লাহর পদযুগল থেকে সৃষ্ট। এ কারণে তাকে অস্পৃশ্য ও কুলাঙ্গার হিসাবে গণ্য করত। সমাজের প্রভু শ্রেণিদের জন্য তাদের দাস-দাসীদের শাস্তি দেওয়া বা হত্যা করাকে বৈধ মনে করা হতো। এ রকম একটি সমাজকে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমনভাবে পরিবর্তন করেন, যেখানে কোনো মানবিক ভেদাভেদ ছিল না। সেখানে তিনি কোনো ভাষাগত, দেশগত, শ্রেণিগত, বর্ণগত ও মর্যাদাগত বৈষম্যের চিহ্ন রাখেননি। এ ব্যাপারে তাঁর ঘোষণা ছিল-ওহে মানুষেরা! নিশ্চয় তোমাদের রব এক। তোমাদের পিতা এক।

সাবধান! তাক্বওয়া ছাড়া কোনো আরবের প্রাধান্য নেই আজমের ওপর এবং আজমেরও প্রাধান্য নেই আরবের ওপর। আর কোনো লালের প্রাধান্য নেই কালোর ওপর এবং কোনো কালোর প্রাধান্য নেই লালের ওপর। নিশ্চয় আল্লাহর দরবারে তোমাদের মধ্যে সেই সার্বোত্তম, যে অধিক মুত্তাকি। সাবধান! আমি কি (রিসালাতের দায়িত্ব) পৌঁছিয়েছি? তারা বললেন : অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বললেন, সুতরাং যে উপস্থিত সে যেন অনুপস্থিতের কাছে পৌঁছে দেয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) শত্রু-মিত্র, সমর্থক বা বিরোধী, মুসলিম বা অমুসলিম সবার সঙ্গে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। নিজের নিকট আত্মীয় হলেও কোনো রকম পক্ষপাতমূলক বিচার করতেন না। একবার মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক মহিলা চুরি করল। উসামাহ (রা.) তার ওপর আল্লাহর বিধান কার্যকর না করার সুপারিশ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছ?

এরপর তিনি দাঁড়ালেন এবং লোকদের উদ্দেশে, ‘হে মানুষেরা তোমাদের পূর্ববর্তীরা এজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, যখন তাদের মধ্যে মর্যাদাশীল কেউ চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন দুর্বল কেউ চুরি করত তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করত আমি অবশ্যই আর হাত কেটে দিতাম। বানু নাযীর যখন বানু কুরাইযার কাউকে হত্যা করত তখন অর্ধেক রক্তমূল্য প্রদান করত, আর বানু কুরাইযা যখন বানু নাযীরের কাউকে হত্যা করত তখন তাদের পূর্ণ রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হতো।

কিন্তু যখন আল কুরআনের এ আয়াত নাজিল হলো-আর তারা যদি কখনো (কোনো বিচার নিয়ে) তোমার কাছে আসে তাহলে তুমি (চাইলে) তাদের বিচার করতে পারো কিংবা তাদের উপেক্ষা কর। যদি তুমি তাদের উপেক্ষা কর, তা হলে (নিশ্চিত থাক), তারা তোমার কোনোই অনিষ্ট করতে পারবে না। তবে যদি তুমি তাদের বিচার-ফায়সালা করতে চাও, তাহলে অবশ্যই ইনসাফসহকারে বিচার করবে।

নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের মধ্যে সমান রক্তপণ ধার্য করেন। পৃথিবীর কোনো বিচারক রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতো ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। সত্য ও ন্যায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একমাত্র তিনিই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে করে দেখিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *