ডিমের বাজার বেশ টালমাটাল ছিল মাসখানেক। প্রতি ডজনের দাম ১৮০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমদানির উদ্যোগ, শুল্ক কমানো, মধ্যস্বত্বভোগীদের দমিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সরাসরি পাইকারি বাজারে ডিম সরবরাহ করাসহ সরকারের নানা উদ্যোগে বাজার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ডজন নেমে আসে ১৪৫ টাকায়। তবে এই স্বস্তি বজায় থাকছে না। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও সংকট বাজারে। মানা হচ্ছে না সরকার নির্ধারিত দর।

ডিমের বাজারে এমন বিশৃঙ্খলা নিয়ে ব্যবসায়ীরা তুলছেন নানা অভিযোগ। ‘কৃত্রিম’ সংকট সৃষ্টির কথাও বলছেন কেউ কেউ। গতকাল ঢাকার পাইকারি বাজার তেজগাঁও, কাপ্তানবাজার এবং কয়েকটি খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক দোকানে ডিম নেই। কারওয়ান বাজারে বেশির ভাগ খুচরা ডিম ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ রেখেছেন। কিছু দোকানে ডিম দেখা গেলেও পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। ফার্মের ডিম প্রতি ডজন কোথাও বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা, কোথাও ১৭০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলেন, শুধু রাজধানীতে দৈনিক গড়ে এক কোটি পিস ডিমের দরকার হয়। সে তুলনায় সরবরাহ কম। এই ঘাটতির কারণে বাজারে এলোমেলো পরিস্থিতি হয়েছে। কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী জানান, আড়তে ডিমের সংকট। চাহিদা অনুযায়ী ডিম দিচ্ছেন না আড়তদার। দুই হাজার পিস চাইলে দেন এক হাজার পিস। দামও দিতে হচ্ছে কিছুটা বেশি। এদিকে আড়তদাররা বলছেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ না করার কারণে এমন পরিস্থিতি। সরকারের সমঝোতায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার দুই বড় পাইকারি বাজার তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারে দৈনিক ২০ লাখ পিস ডিম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও দিচ্ছে ১০ থেকে ১৩ লাখ। এর প্রভাব পড়েছে আশপাশের খুচরা বাজারে।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের ‘যৌক্তিক’ দর নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, যা পাইকারিতে হবে ১১ টাকা ১ পয়সা। খুচরা পর্যায়ে প্রতিটির দাম হবে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা, অর্থাৎ প্রতি ডজনের দাম হবে ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। কিন্তু নির্ধারণের পর সেই দরে কোথাও পাওয়া যায়নি ডিম। উল্টো ধীরে ধীরে বাড়ছে। সরকার সম্প্রতি ডিমের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। কয়েক ধাপে আমদানিও হয়। তবু বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসায় গত ১৬ অক্টোবর থেকে তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারে দৈনিক ২০ লাখ পিস করে ডিম সরবরাহ করা হবে– এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে রয়েছে কাজী ফার্ম, ডায়মন্ড, প্যারাগন, নারিশসহ ১৩টি কোম্পানি। কিন্তু ভোক্তা অধিদপ্তরকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি তারা। দুই বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এক দিনও ২০ লাখ পিস সরবরাহ করেনি তারা। কিছু কোম্পানি স্বল্প পরিমাণে সরবরাহ করলেও অধিকাংশ কোম্পানি সরবরাহ করছে না। তেজগাঁওয়ে গত এক সপ্তাহে আট কোম্পানি থেকে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭২ পিস ডিম সরবরাহ হয়েছে। গড়ে দৈনিক এসেছে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮১ পিস। কাপ্তানবাজারে দৈনিক সরবরাহ হয়েছে ছয় লাখের মতো।

তেজগাঁওয়ে দৈনিক ৩০ লাখ ও কাপ্তানবাজারে ২৫-৩০ লাখ পিস ডিমের চাহিদা রয়েছে। সব মিলিয়ে রাজধানীতে প্রতিদিন এক কোটির চাহিদা রয়েছে বলে জানান পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের অন্যতম বড় সংগঠন তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ সমকালকে বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন গড়ে পাঁচ লাখ পিসের মতো দিচ্ছে। চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। ডিম সংকটে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ লোকসান গুনছেন। তিনি জানান, তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজার ছাড়া অন্য বাজারগুলোতে দর বেশি। কারণ, সেগুলোতে ব্যবসায়ীরা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে বেশি দরে কিনে বেশি দরে বিক্রি করছেন। তারা প্রতিটি ১১ টাকা ৬০ পয়সা দরে কেনেন। কিন্তু তেজগাঁওয়ে আড়তদাররা সরকারের নির্ধারিত দরের বাইরে যেতে পারছেন না। এখানে প্রতিটির পাইকারি দর ১১ টাকা ১ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা গুনতে হয়।

কাপ্তানবাজার ডিম ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়ক মাসুদুর রহমান বলেন, এই বাজারে পাঁচজন ডিলারকে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডিম সরবরাহ করে। অন্য ব্যবসায়ীরা ডিম সংগ্রহ করেন মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। এখন সরকার নির্ধারিত দরে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডিলারদের ডিম দিচ্ছে। ডিলাররাও নির্ধারিত দরে বিক্রি করেন। অন্য ব্যবসায়ীরা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে সংগ্রহ করায় দাম বেশি দিতে হয়। তাদের বিক্রিও করতে হয় বেশি দামে। কিন্তু সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় সে সুযোগ নেই বাজারে। এ জন্য তারা ডিম সংগ্রহ থেকে বিরত রয়েছেন। এতে সংকট তৈরি হয়েছে।
এগ প্রডিউচারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় অনেক খামার ধ্বংস হয়ে গেছে। তার পরও উৎপাদন কিছু কিছু হয়। তবে ডিম সংকটের পেছনে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় ডিলারের কারসাজি থাকতে পারে। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বিপিএর সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, প্রতিদিনই দর নির্ধারণ করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম ওঠানামা করে তাদের মর্জিমতো। বাজার অস্থির করার পেছনে তারা দায়ী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মাহাবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘দৈনিক ২০ লাখ পিস করে ডিম সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু উৎপাদন সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। মুরগি তো মেশিন নয় যে সব সময় সমান হারে ডিম দেবে। উৎপাদন সংকট কয়েক মাস ধরেই চলছে।’
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কারসাজি করে সংকট তৈরি করছে– এ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি ভিত্তিহীন কথা। উদ্যোক্তারা ডিম উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি না করে আটকে রেখে কী করবে। উদ্যোক্তারা সরকারকে সহযোগিতা করার জন্যই বাজারে নিজ উদ্যোগে ডিম সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলীম আক্তার খান সমকালকে বলেন, বাজার তদারকি ও ভোক্তার জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে অধিদপ্তর কাজ করছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *