রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রেস ব্রিফিং থেকে এই চিঠি পাঠ করেন শিক্ষার্থীরা। চিঠিতে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লেখেন, ‘আমরা করোনার সেই বিপদের সময়ে বানিয়েছি লো কস্ট ভ্যান্টিলেটর, ক্লিন সিটির আশায় পরিত্যক্ত মাস্ক থেকে বানিয়েছি কংক্রিট, খুঁজছি বিদ্যুত উৎপাদনের সহজ উপায়, বানাচ্ছি আর্টিফিসিয়াল আর্মস, মাট্রিক্যাল টুলস। পদ্মা সেতু নির্মাণে আমাদের বুয়েট শিক্ষক এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের অবদান অনবদ্য। শুধু দেশেই না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাল্লা দিয়ে আমরা ছিনিয়ে আনছি বিজয়। আপনি নিঃশর্তভাবে আমাদের অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন এসব গবেষণা খাতে।’
প্রধানমন্ত্রীকে অভিভাবক সম্বোধন করে তারা বলেন, ‘আমরা নিজেদের মেধা ও শ্রমের সবটুকু দিয়ে বিজ্ঞানের অবাক করা দুনিয়ার একটা অংশের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না, আমরা শুধু দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। আপনি আমাদের সবার অভিভাবক, আপনি দেশের অভিভাবক। আমরা জানি দেশের কোথাও কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতি চললে, দেশের কোথাও সংকট চললে, আপনার হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে এই দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।’
বুয়েট শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সূচনা ঘটছে আধিপত্য, দাপট, র্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মত ঘটনা। এ ব্যাধি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর চরম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ৯৯ এর সাবেকুন্নাহার মনি, যন্ত্রকৌশল ০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ১৭ এর আবরার ফাহাদকে হারিয়েছি। শুধুমাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডই নয়, এর পূর্ববর্তীতেও অসংখ্য শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের দ্বারা কিংবা ছাত্ররাজনৈতিক দাপটের দ্বারা অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা রযেছে, যা আমাদের বুয়েটের র্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে।’
খোলা চিঠিতে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে আরও লেখেন, ‘বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বরাবরই একটি নিরাপদ এবং সুপ্ত ক্যাম্পাস চেয়ে এসেছে। যেখানে ক্ষমতাচর্চার লোভ লালসার শিকলে আবারও জিম্মি হয়ে যাবে না সবার নিরাপত্তা, শিক্ষাঙ্গনের উপযুক্ত পরিবেশ। সুপ্ত নেতৃত্ব এবং নৈতিকতা বিকাশের সব উপাদান ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি ছাড়াও গত কয়েক বছরে উপস্থিত ছিল এবং এতে সুস্থ নেতৃত্বের চর্চার শিক্ষার্থীরা তাদের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের বাৎসরিক ফেস্টিভ্যাল আয়োজন, প্রতিটি ডিপার্টেমেন্টের নিজস্ব সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং একাডেমিক অর্গানাইজেশন, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, বিভিন্ন ক্লাবের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে আনন্দের সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। আবাসিক হল এবং ক্যাম্পাসে কোনো প্রকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ক্ষমতা চর্চা ছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সভা-সেমিনার আয়োজন, জাতীয় সহশিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্জনসহ ক্যাম্পাসের ভেতরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সফলভাবেই আয়োজিত হয়েছে।’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বর্তমান বুয়েটে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ থাকায় নিজ নিজ প্রকৌশল ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামুখী কাজে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একটি রাজনীতিবিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য দেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। রাজনীতিমুক্ত বুয়েট ক্যাম্পাসে গত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব সফলতা আমাদের জানান দেয়, আমরা আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ছাড়াও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব গঠন এবং বিকাশ প্রয়োজন, তা করতে পারি। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিরন্তর কাজ করে যেতে পারি।
তারা বলেন, ‘আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের ব্যাপারে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তাই দেশের যে কোনো স্থানের ন্যায় আমাদের ক্যাম্পাসকে আমরা অবশ্যই যেকোনো প্রকারের সন্ত্রাস, মৌলবাদ বা নিষিদ্ধ গোষ্ঠী থেকে নিরাপদ রাখতে সর্বদা তৎপর। সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মহল থেকেই বলা হচ্ছে যে, ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ মৌলবাদী বা সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম বিদ্যমান এবং এর ফলশ্রুতিতেই তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির চর্চার পক্ষে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যদি যেকোনো মুহূর্তে এসব নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যে কোনো কার্যকলাপ ক্যাম্পাসে চলমান দেখি, শিগগির তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবো এবং প্রশাসনকে অবহিত করবো। এমনকি ভবিষ্যতে যদি ক্যাম্পাসে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সেটার বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান দৃঢ়।’
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘চার বছর আগে আপনার দৃঢ় এবং দ্রুত হস্তক্ষেপে আমরা নতুন করে এই ক্যাম্পাসে বাঁচতে শিখেছি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই ছোট্ট একটা চাওয়ার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি হুমকি, হচ্ছি লাঞ্ছিত, অপদস্ত। আমরা ও আমাদের ছোট ভাই-বোনেরা আরও একবার সেই অন্ধকার দিনগুলোর সাক্ষী হতে চাই না। আমাদের উপাচার্য এবং শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা জানি তারা তাদের সন্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় সর্বদা সচেষ্ট আছেন এবং থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সবসময় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন, আমরা জানি এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’
সবশেষে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখা ও শিক্ষার্থীদের গবেষণার পথচলা নির্বিঘ্ন রাখার অনুরোধ জানান।