ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে গত বছর ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরেই ৬৪টি দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা ৮৫। চলতি বছর প্রথম সপ্তাহে প্রাণ গেছে ৪ জনের, আহত হয়েছেন আটজন।
২০২০ সালে চালু হওয়া ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জ অংশে গত বছর শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪৯৭টি।
চলতি সপ্তাহেই গত বৃহস্পতিবার রাতে দু’জন ও শুক্রবার দু’জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচজন। রোববার সকালে তিনজন আহত হয়েছেন।
গত ২৭ ডিসেম্বর দুপুরের ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। এদিন ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বেপারী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারকে চাপা দেয়। এতে প্রাণ যায় দুই পরিবারের চার নারীসহ ছয়জনের। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয় আরও অন্তত চারজন। দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে টোল প্লাজার কাছাকাছি এসে হঠাৎই গতি বৃদ্ধি করে যাত্রীবাহী বাসটি। বাসটির ফিটনেস সনদ ও চালকের লাইসেন্স ছিল না। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বাসচালক নুর উদ্দিন। গ্রেপ্তার বাস মালিক ডাবলু বেপারী দুর্ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন।
দুর্ঘটনায় স্ত্রী, দুই কন্যা ও নাতিহারা রাজধানীর জুরাইনের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন টোলপ্লাজার দুর্ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন।
ঘন কুয়াশা, যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক আইন মেনে না চলা– সব মিলিয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। প্রতিদিন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে ৫৫ কিলোমিটারের এ সড়কে।
গত ২২ ডিসেম্বর ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর থেকে হাঁসাড়া পর্যন্ত চার কিলোমিটার অংশে চারটি দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেট কার পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ডভ্যানসহ ১৩টি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ। হয়। পরদিন ২৩ ডিসেম্বর ঘন কুয়াশায় ধলেশ্বরী সেতুর ওপর প্রাইভেট কার ও পিকাপভ্যানের সংঘর্ষে এক নারী নিহত ও অপর পাঁচজন আহত হন। এরপরই ঘটে ২৭ ডিসেম্বরের সেই ঘটনা।
মুন্সীগঞ্জের হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদির জিলানী বলেন, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮৫ জন আহত হয়েছেন, মারা গেছেন ১০ নারীসহ ২২ জন। এর মধ্যে গত বছর ডিসেম্বরেই মারা গেছেন ১০ জন।
বাসচালক মোহন মিয়া বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে ঘন কুয়াশার কারণে এখন বেশি সমস্যা হচ্ছে। সড়কবাতিগুলো ঠিকভাবে জ্বলছে না। হেড লাইট জ্বালিয়েও পথ দেখা যায় না। সড়কে গাড়ি থামিয়ে রাখলেও ঝুঁকি, পেছন দিয়ে মেরে দেয়।
সড়ক-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটিকে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে বলা হয়। এর নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’। মহাসড়কটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ৫৫ কিলোমিটার এ মহাসড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকা।
পুলিশের টহলদারি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, পুলিশের সামনে কম গতিতে গাড়ি চালালেও পুলিশ দূরে চলে গেলে আবার বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা। সড়কের সার্ভিস লেনে যানবাহন চলাচলের জন্য গতিসীমার নির্দেশনা রয়েছে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার, তবে মূল সড়কের গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার। মহাসড়কে একাধিক দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ। সেখানে থাকা স্পিড গান দিয়ে দেখা গেছে, কোনো কোনো যাত্রীবাহী বাসের গতি সর্বনিম্ন ৯৯ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২৪ কিলোমিটার। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফুট ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহারে অনীহা রয়েছে অনেকের। এতে প্রায়ই গাড়ি চাপায় নিহত হচ্ছে অনেক পথচারী।
মুন্সীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, সড়কের চেয়ে টোলপ্লাজাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশি থাকার কথা থাকলেও এখানেও দুর্ঘটনা হচ্ছে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ঘন কুয়াশায় ফগ লাইট না জ্বালানো। রাতের আঁধারে, ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টির মধ্যে দুর্ঘটনা বেশি হয়। ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালালে, চালকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণ ও যাত্রীরা সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
মুন্সীগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহমুদ সুমন জানান, সরকারি হিসাবে এই এক্সপ্রেসওয়েতে ২০২২ সালের জুন থেকে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৯০টি দুর্ঘটনায় ১৪০ জন নিহত ও ১ হাজার ৪৪৫ জন আহত হয়েছেন।
হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার ড. আ ক ম আকতারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, মহাসড়কে বা পরিবহন সেক্টরের যেখানেই হোক না কেন সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।