পিলখানায় গণহত্যা, রাজনৈতিক গুম-খুন, ধর্ষণ, অনিময়-দুর্নীতি ও দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করলেও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারকে নীরব সমর্থন দিয়েছে দেশের সিভিল সোসাইটি। গোয়েন্দা সংস্থার ভয়ে সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেনি দেশের এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোও। ফলে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। সমাজের প্রতিটি স্তরে তৈরি হয়েছে বৈষম্য। দেশের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে বর্তমান প্রজন্ম। এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, প্রাইভেট, এনজিওসহ সব প্রতিষ্ঠানকে একত্রে কাজ করতে হবে। নইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সহজ হবে না।

শনিবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে ‘নাগরিক সমাজ : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মতবিনিময় সভার আয়োজন করে সিএসও অ্যালায়েন্স। সভা শেষে সিএসও অ্যালায়েন্স কর্তৃক ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর : আর্থসামাজিক পরিবর্তনে নাগরিক সংগঠনের ভূমিকা’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়।

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সরকার ও বিভিন্ন কমিশন আলাপ-আলোচনা করছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের মুখপাত্রদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের নয়, এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। এটির বাস্তবায়নে নাগরিক সমাজের সহযোগিতা অপরিহার্য। সেজন্য নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। সরকারের কোনো উদ্যোগে ঘাটতি থাকলে তা উলে­খ করতে হবে। সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। প্রথাগত সরকারের থেকে বর্তমানে সবকিছু ভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থার অবদান অনেক। আমাদের কমিউনিটির বন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে। এনজিও ব্যুরোকে স্বচ্ছ হতে হবে।

সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা করতে পারিনি। এ কারণে আজ তরুণ প্রজন্ম আমাদের প্রত্যাখ্যান করছে। তারা বলছে, তোমরা বৈষম্য করেছ। তারা নিজেরাই আন্দোলন করে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায় করেছে। এ প্রথা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নাগরিক সমাজ স্বাধীনতা ও স্বাধীকার আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। আশির দশকে মানবাধিকার এবং নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তারা সক্রিয় ছিল।

দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে যখনই যে সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, তারাই বেসরকারি সংস্থাগুলোকে শত্র“ হিসাবে দেখে। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে নতুন বাংলাদেশের কিছু মানুষ বৈষম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, যা উদ্বেগজনক। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, এর জন্য নাগরিক সমাজকে নীরব না থেকে কাজ করতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাষ্ট্র মেরামতে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, এনজিও এবং প্রাইভেটসহ সব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবকিছুতে আমাদের ভ‚মিকা আছে। তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, নাগরিক ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য অনুপস্থিত। ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে সীমিত হয়েছে। সিভিল সোসাইটির ভ‚মিকা নির্ভর করবে রাজনৈতিক উদ্যোগের ওপর। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছিল নাগরিক সাম্য, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তির। কিন্তু সেই প্রতিশ্র“তি পূরণ হয়নি বলেই ২০২৪ সালে ছাত্ররা আন্দোলন করেছে।

সিএসও অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, এদেশ আমাদের সবার। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা অনস্বীকার্য। সেই দায়বদ্ধতা থেকে নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্নভাবে অবদান রেখে আসছে। আগে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল; কিন্তু এখন সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার।

তরুণ প্রতিনিধি নাজিফা জান্নাত বলেন, নাগরিক সমাজের ভেতরে জেনারেশন গ্যাপ কমিয়ে সংলাপ বাড়ানো দরকার। যাতে প্রজন্মগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে। সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠদের নয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন দ্রব্যমূল্য হ্রাস, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নাগরিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হতে পারে।

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ল্যান্ডমার্ক ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রমুখ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *