রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের ট্রেন যুগপৎ চলতে পারে। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধ, সংঘাত কাম্য নয়। সমষ্টির প্রয়োজনে ক্ষুদ্র স্বার্থকে পরিহার করে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মানুষকে ভালোবাসতে শিখতে বা জানতে হয়। সে কারণেই হয়তো গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতকে সম্মান জানাতে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতি বোঝার সক্ষমতা বিবেকবান সচেতন নাগরিকের ধর্ম-কর্মও বটে। তা না হলে কণ্টকাকীর্ণ হতে পারে জাতীয় জীবনের অগ্রগতির পথ।

অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা ও ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। কিন্তু সময়ের গতিপথে সরকারের ওপর বহুমুখী চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা থেকে সরকারকে তেমন চাপে রাখতে পারে। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের ষড়যন্ত্র বা অন্য যে কোনো কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হলে বা কোনো কারণে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হলে নির্বাচন প্রলম্বিত হতে পারে– এমন বিবেচনায় অস্বস্তি বোধ করেই হয়তো সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের চাপের মুখে রাখতে চাইছে।

দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে দীর্ঘদিন আন্দোলনে থাকা, দমনপীড়নের শিকার হওয়ার কারণে জনগণের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হয়েছে এবং দ্রুত নির্বাচন হলেই তার ফসল দলটি ঘরে তুলতে পারে। বিলম্বে তা কিছুটা হলেও পোকায় খেয়ে ফেলতে পারে– এমন উপলব্ধি থেকে দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা ও সংকটের চিন্তা তীব্রতর হতেই পারে। আবার পতিত সরকারপ্রধান ভারতে বসে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরে পাওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তিনি এবং তাঁর দলের অস্তিত্বের সংকট আজ সুস্পষ্ট। তাই দলটি আপন অস্তিত্ব ফিরে পেতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে– সে তো জানা কথা। তবে সাধারণ মানুষ তাকে কীভাবে নেবে– সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।
অনেকে বলছে, দেশের মানুষের চরিত্র যেমন, সে দেশের সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা হতে পারে তেমন। ভালো মানুষের সরকার সেখানে আসতে পারে না। এলেও তাকে টিকতে দেওয়া হবে না। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সচেতন মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সেটা কি সব মানুষ ধারণ করতে পেরেছে? তা যে আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তির পথ দেখাতে পারে; জাতির মুক্তির সনদ হতে পারে, তা কি সংকীর্ণ চিন্তার স্বার্থপর মানুষরা ভাবতে পারে?

সেটা ভাবতে পারে না বলেই তাই সমাধানের দিকে না গিয়ে তাৎক্ষণিক কিছু পাওয়ার চিন্তায় আন্দোলন, সড়ক অবরোধ করতে দেখা যায়, যা দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা। তখন মনে হয়, সংস্কারের পক্ষে মানুষকে প্রস্তুত করা দরকার; সে কাজে নাগরিক সমাজ ও সরকারের যৌথ ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সেদিকে যথাযথ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
তবে আগামী তিন মাসের মধ্যে দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে সংস্কারের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। জনমত প্রবল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে সরকার ও ছাত্র-জনতার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করলে তা একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তার জায়গাটা কিছুটা হলেও দুর্বল করতে পারে। কেউ কেবল প্রয়োজনে একটি ভালো নির্বাচন বললেও এবং ৯০-এর পরে বেশ কয়েকটা ভালো নির্বাচন হলেও কেউ কথা রাখেনি বলে জনমনের সংস্কারের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আর ছাত্র-জনতা ও অন্তর্বর্তী সরকার সে প্রত্যাশার জায়গায় আলো ছড়িয়েছে। তাকে পাশ কাটিয়ে গেলে সরকার জনগণের আশাভঙ্গের কারণ হতে পারে। আবার নির্বাচনের পক্ষে আন্তর্জাতিক চাপও থাকতে পারে, তবে তারা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারে সমর্থনের কথাও বলেছে। সরকারের দুর্বলতা, নাগরিক সমাজের কাছে নিজের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে তাকে যেতে দেখা যায় না; কেবল গণমাধ্যমই ভরসা। দুই-চারজন উপদেষ্টার রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় নাগরিক সমাজের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে, নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে, যুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে হয়।

আমরা যদি বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে না পারি; দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলি, তাহলে নামমাত্র কিছু সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি যৌক্তিকতা খুঁজে পেতে পারে। পরিবেশ অনুকূলে না থাকলে সরকারও হয়তো সে পথে হাঁটতে বাধ্য হবে। তবে আমার ধারণা, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের ট্রেন পাশাপাশি চলতে পারে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। ভোটার তালিকা সংশোধনকালেই সংস্কারের একটা রূপরেখা বেরিয়ে আসতে পারে। ভোটার তালিকা সংশোধনকালসহ নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পরই ঘোষণা করা যেতে পারে। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো আশ্বস্ত হতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে পরিপক্বতা, ধৈর্য ও সমঝোতার পথ হতে পারে এই মুহূর্তে যথার্থ পথ। অর্থাৎ জনগণের প্রত্যাশাকে বিবেচনায় নিয়ে সব পক্ষের সংঘাত এড়িয়ে চলাই হতে পারে দেশাত্মবোধের পরিচায়ক। অন্যথায় জাতির জীবনে ঘটতে পারে বিপর্যয়, যা কারও জন্য সুখকর নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *