প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান সভ্যতা আমাদের ব্যর্থ করেছে। পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি আত্মধ্বংসী সভ্যতা হয়ে উঠেছে। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পদের চরম সঞ্চয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। এমন একটি অর্থনীতি গড়তে হবে, যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া যাবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে তিন দিনব্যাপী বে অব বেঙ্গল সংলাপের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। খবর বাসসের।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আসুন, আমরা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করি, একে অপরের কথা শুনি এবং একটি নতুন পৃথিবী কল্পনা করার সাহস করি, যা পরিবেশগতভাবে নিরাপদ পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলি, যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে, শুধু কিছু বিশেষ সুবিধাভোগীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।’ ড. ইউনূস উল্লেখ করেন, তিনি সব সময়ই আশাবাদী মানুষ এবং উদ্ভাবনী ধারণা ও কল্পনার শক্তিতে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা একসঙ্গে কল্পনা করতে পারি, তাহলে সেটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আসুন আমরা এটি করি।’ কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিন শূন্যের ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি পৃথিবী তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। এই ধারণা হলো, শূন্য কার্বন নির্গমন, সম্পদের শূন্য কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব। এর জন্য তিনি সামাজিক ব্যবসা প্রচলনের কথা বলেন, যা মানুষের সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়, কেবল মুনাফা করা যার মূল উদ্দেশ্য নয়।
একই সঙ্গে যুবকদের চাকরিপ্রার্থী না বানিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ওপরও জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা।
উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য তিনি দ্রুত ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ার ওপর জোর দেন, যেখানে সবাই উপকৃত হবে। তরুণদের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা একই সঙ্গে অপরিসীম সম্ভাবনার একটি অঞ্চল। আমাদের দেশ তরুণদের দেশ। ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২৭ বছরের নিচে। এটি আমাদের দেশকে সৃজনশীলতায় অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছে। যুবসমাজের মধ্যে টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবুজ প্রবৃদ্ধির মডেল তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, সাহস এবং অমিত ভবিষ্যৎকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রতি অটুট বিশ্বাস।
ড. ইউনূস বলেন, ‘এই সম্মেলনে আগামী কয়েক দিন ধরে আমরা যখন আলোচনা করব এবং আমাদের চিন্তাভাবনা ভাগাভাগি করব, আমি আপনাদের অনুরোধ করব, কীভাবে একটি নতুন বিশ্ব গড়া যায়, তা নিয়ে ভাবতে। আমাদের যুবসমাজ আমাদেরকে নতুন বাংলাদেশ তৈরির পথে পরিচালিত করেছে।’ সম্মেলন আয়োজন করায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সম্মেলন শুধু মতবিনিময়ের স্থান নয়; এটি আমাদের অভিন্ন সহনশীলতার প্রমাণ। বাংলাদেশ সব সময় স্বপ্ন, কঠোর পরিশ্রম এবং অবিচ্ছেদ্য ইচ্ছা পূরণের দেশ হিসেবে প্রমাণ করেছে। এটি এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ, বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাগুলো এখনও সবার মনে সতেজ। এই আকাঙ্ক্ষা লাখো কণ্ঠের আওয়াজ, প্রায় পুরো জাতির আওয়াজ, তারা পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। আমাদের সবাইকে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।’ অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বক্তব্য দেন।
তরুণদের আঁকা গ্রাফিতি দেখার আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বে অব বেঙ্গল সংলাপে অংশ নেওয়া বিদেশি অতিথিদের বাংলাদেশের তরুণ বিপ্লবীদের গ্রাফিতি ও চিত্রকর্মগুলো ঘুরে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় দেয়ালে আঁকা বর্ণিল চিত্রকর্মগুলো দেখার ঐতিহাসিক সুযোগ আপনারা নষ্ট করবেন না। এই চিত্রকর্মগুলো তরুণদের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ, যা হত্যাযজ্ঞের সময় আঁকা হয়েছিল। এগুলো দেখলে যে কেউ বিস্মিত হবেন, কী গভীর শক্তিশালী চিত্রকর্ম তরুণরা তুলে ধরেছে।’ অতিথিদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারা সত্যিই আনন্দের। এই শহরটি মাত্র ১০০ দিন আগে এক অনন্য রাজনৈতিক উত্থানের সাক্ষী হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ আলাদা এক বাংলাদেশ।’ তিনি বলেন, প্রায় ১ হাজার ৫০০ ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য বিক্ষোভকারী স্বৈরশাসকের হাতে নিহত হয়েছেন এবং আহত হন প্রায় ২০ হাজার। এই বৈশ্বিক সংলাপের মাধ্যমে, আসুন আমরা সেই মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চোখ ও অন্যান্য শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন এবং যারা এখনও জীবন নিয়ে লড়াই করছেন।