অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘আমাদের সরকার খুব স্বল্পকালীন। আগামী বছর আমরা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব। এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত মত। এরপর দেখা যাক।’
শনিবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে ‘সমতা’ বিষয়ে বিশেষ বক্তব্য দেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘বর্তমানে উচ্চ-মধ্যম আয়ের ফাঁদের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। নিম্ন-মধ্যম আয়ের ফাঁদের কথা আমরা ভাবছিই না। মালয়েশিয়া তো দূরের কথা অর্থনৈতিকভাবে থাইল্যান্ডের পর্যায়ে কীভাবে যাওয়া যাবে, সেটা এখনও চিন্তা করিনি। ১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশের সমান মাথাপিছু আয় ছিল ভিয়েতনামের। সেখানে এখন বিদেশি বিনিয়োগ আসে ২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে আসে এক থেকে দুই বিলিয়ন। বর্তমানে ভিয়েতনামের সঙ্গে ৩০ থেকে ৪০টি দেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) রয়েছে। বাংলাদেশের একটি দেশের সঙ্গেও এফটিএ নেই।
তিনি বলেন, ভিয়েতনামের গড় শুল্ক ৬ থেকে ৭ শতাংশ, বাংলাদেশে যা ৩০ শতাংশ। শুল্কের এ বড় ব্যবধানে বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্ভব নয়। সুতরাং বাংলাদেশের শিল্পগুলোকে আরও বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হতে হবে। শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে হবে না। বর্তমানের শিক্ষা যে অবস্থায় রয়েছে, এ মানবসম্পদ দিয়ে একদমই হবে না।
এক প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এলিডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) তালিকা থেকে উত্তরণের কথা রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এ সময়টা আরও বাড়িয়ে নেওয়া যায়। আবার কেউ বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উত্তরণ ভালো। উত্তরণ উচিত কিনা– এর চেয়ে বড় কথা হলো, ইচ্ছা করলেই বাড়তি সময় পাওয়া যাবে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তিনটি সূচকে দুবার উত্তীর্ণ হয়েছে। জাতিসংঘের এ-সংক্রান্ত কমিটিতে তিনি নিজেও ছয় বছর ছিলেন। মালদ্বীপসহ বেশকিছু ছোট দ্বীপরাষ্ট্র বাড়তি সময় চাইলেও সফল হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী পরপর দুবার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হলে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। তবে উত্তরণের পরও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের কাছে কিছু সময় এলডিসির সুবিধা অব্যাহত রাখা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে কানাডা, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ধরনের সুবিধা দিতে সম্মত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তাই এ ক্ষেত্রে এলডিসি থাকা, না থাকা কোনো বিষয় নয়। তৈরি পোশাক অন্তর্ভুক্ত না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা হারানোটা তখন গায়ে লাগেনি। তবে এ কারণে দেশটিতে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার যে সম্ভাবনা ছিল, সেটি হয়নি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এলডিসিসহ ১৪০টির মতো দেশে এ সুবিধা দেয়। অথচ বাংলাদেশ এখনও তা উদ্ধার করতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি খুব দুর্বল। এখানে উন্নতি করতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, সারা দেশের চর, জলাধার, হাওর ও বিল প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়। যদি কৃষক সংগঠন শক্তিশালী হতো, কাঠামোগত গণতন্ত্র থাকত এবং প্রান্তিক পর্যায়ে গণতন্ত্র মজবুত হতো, তাহলে অনেক লাভ হতো। তিনি বলেন, আয়বৈষম্য এ মুহূর্তে একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। বৈষম্য দূর করতে মানসম্পন্ন শিক্ষা দরকার, যেখান থেকে অনেক দূরে রয়েছে বাংলাদেশ।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, গত সরকারের আমলে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি ভালো প্রকল্প আছে। আবার অনেকগুলোই ‘প্রেস্টিজ প্রকল্প’ বা সুখ্যাতি অর্জনের জন্য নেওয়া হয়েছিল। এসব নিয়ে কী করা যায়, তা ভেবে দেখা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ কীভাবে সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে পারে– এমন প্রশ্নে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে সম্পদের বড় ধরনের স্বল্পতা আছে। বড় অনেক কোম্পানির টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে। ব্যাংকের টাকা বাইরে চলে গেছে। বেক্সিমকোর মতো বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্থিতিপত্রে অনেক টাকা থাকলেও বাস্তবে দেশের মধ্যে নেই। তাদের প্রচুর শ্রমিককে মজুরি দিতে হবে। কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে।
সম্পদ স্বল্পতার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো কঠিন বলে মন্তব্য করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিশেষত জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বেশি সম্পদ দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন ডায়ালাইসিস মেশিন কেনা হবে নাকি জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা হবে– এটা নৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি মনে করেন, এই নৈতিক উভয় সংকটের জবাব অমর্ত্য সেন বা জন রলসের মতো অর্থনীতিবিদরাও দিতে পারবেন না।
বাংলাদেশের পক্ষে ধনী দেশ হওয়া সম্ভব কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘সবাই মিলে আমরা করতে পারি। সবাই মিলে ভাবা যাবে, কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়। তবে একটি দেশ কখনও হঠাৎ করে ওইভাবে উন্নতি করে না।’
অধিবেশনে সূচনা বক্তব্যে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্যের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য বাড়ছে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী মনোভাব আরও বড় হিসেবে তৈরি হয়েছে। সেই চেতনা সামনে রেখে বৈষম্য দূর করতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।