স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সকল ফেডারেশন তৃণমূল পর্যায়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার অধীনে স্ব স্ব খেলাধুলা পরিচালনা করে আসছে। ২০০৮ সালের বাফুফে নির্বাচনের আগে ফিফার ধুয়া তুলে ফুটবল জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে বের হয়ে আলাদা এসোসিয়েশন করে। সরকারি প্রভাবমুক্ত ও ফুটবলের উন্নয়নের জন্য করা হলেও আদতে এটি নির্বাচনে বাফুফের কতিপয় কর্মকর্তার ‘ভোট ব্যাংক’–এ পরিণত হয়েছে। বিগত নির্বাচনের মতো সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনেও জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের ভোটাররাই ছিলেন জয়-পরাজয়ের নিয়ন্ত্রক। ২৬ অক্টোবর বাফুফের নির্বাচনে ৬৬ জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ভোটার ছিলেন। তাদের ভোটে নির্বাচিত বাফুফে কর্তারা গতকাল ২৯ জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের কমিটিই ভেঙে দিয়েছে।
৯ নভেম্বর বাফুফে নতুন কমিটির প্রথম সভায় রাজবাড়ী জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম দুলালকে ডিএফএ মনিটরিং কমিটির প্রধান করা হয়। তার কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই বাফুফে ২৯ ফুটবল এসোসিয়েশনের নির্বাচিত কমিটি বিলুপ্ত করেছে। দুুলাল এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাকে ১৫ দিনের মধ্যে ডিএফএ-গুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। আমি বাফুফের অফিস স্টাফের (মোজাম্মেল মিঠু) তথ্যমতে মূলত খোঁজ-খবর নিয়ে কাজ করেছি। কতবার লিগ আয়োজন করেছে, জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ সংখ্যা, অ্যাফিলিয়েশন ফি দেয় কি না, অডিট রিপোর্ট ও কর্মকর্তারা সক্রিয় রয়েছেন কি না। এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে আমি একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। অনেক সংস্থা অ্যাফিলিয়েশন ফি প্রদান করেনি। সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার বাফুফেই নিয়েছে।’ ৯ নভেম্বর শুধু ডিএফএ মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যানই মনোনীত হয়েছিলেন দুলাল। পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন হয়নি। ফলে দুলালকে একাই কাজ করতে হয়েছে, ‘আমি কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। অনুমোদনের বিষয়টি বাফুফের। চেয়েছিলাম সময় নিয়ে বিভিন্ন জেলা পরিদর্শন করার। সেটার সুযোগ না হওয়ায় স্টাফের তথ্য ও আমার যোগাযোগের ভিত্তিতেই একটি রিপোর্ট দাঁড় করিয়েছি।’
জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সঙ্গে বাফুফের পক্ষে যোগাযোগ রাখেন এক্সিকিউটিভ মোজাম্মেল মিঠু। যার ওপর অনেক জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের ক্ষোভ। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় কাউন্সিলরশিপ ফরম প্রদান ও জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের নির্বাচনেও তার পক্ষপাত আচরণের অভিযোগ অনেক সংগঠকের। সেই মিঠুর তথ্যের ওপর কাজ করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন খোদ ডিএফএ মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান দুলাল, ‘মিঠুর কাছে শরীয়তপুরের লিগ নিয়ে তথ্য ছিল না। তাই শরীয়তপুরকে ধরেই ২৯টি ডিএফএ কমিটি নিয়ে পর্যবেক্ষণ ছিল। শরীয়তপুর জেলা ফুটবল এসোসিয়েশন লিগ আয়োজন করে এবং অনেক খেলাতেই অংশগ্রহণ করে। ওই জেলার সভাপতি সালাম ভাই নিশ্চিত করার পর আমি শরীয়তপুরকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি মিঠুকে অবহিত করেছি। এ ছাড়া আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় দ্রুত ফেডারেশন ত্যাগ করি।’ বাফুফে সভাপতির সঙ্গে ডিএফএ মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান-ও সাক্ষাৎ করেছেন। সেই সময় তালিকায় ২৯ থাকলেও পরক্ষণে ২৮ হওয়ায় সভাপতি বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। আবার মুন্সিগঞ্জ জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের লিগ আয়োজনে অনিয়মিত এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মনিটরিং রিপোর্টে কমিটি বিলুপ্তির সুপারিশ নেই, শুধু লেখা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। বিভিন্ন সূত্রের খবর, এই দুই বিষয়ে মূলত সভাপতি নাখোশ হয়ে ডিএফএ মনিটরিং কমিটিই ভেঙে দিয়েছেন। এতে নতুন প্রশ্ন উঠেছে– কমিটি প্রধানের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হলে তার সুপারিশ কেন গৃহীত হলো?
বাফুফে নির্বাচনের আগে জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের কাউন্সিলর অনিয়ম নিয়ে বেশ সরব ছিলেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশন সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ান। ২৯ নির্বাচিত ডিএফএ ভাঙা নিয়ে তার বক্তব্য, ‘ডিএফএ অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন। আমরা যারা জেলা নিয়ে কাজ করি তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সুন্দর উপায়ে এটি করা যেত। ঢালাওভাবে ২৯ নির্বাচিত কমিটি ভাঙা কখনোই শোভনীয় বা সঠিক নয়।’ ডিএফএ কমিটি ভাঙার মাধ্যমে তাদের নির্বাচনকালীন অভিযোগই সত্য হলো বলে মনে করেন তিনি, ‘আমরা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিলাম ডিএফএ’র বিষয়গুলো নিয়ে। তৎকালীন কমিটি সেগুলো আমলেই নেয়নি।’ গতকাল সভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ২৯ জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের কমিটি বিলুপ্তির বিষয়টি জানিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা প্রকাশ করেনি। ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানা গেছে, কয়েকটি বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের পাশাপাশি ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদুপর, শরীয়তপুর, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগা, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়, নোয়াখালী ও ফেনী রয়েছে কমিটি বাতিলের তালিকায়। এর মধ্যে কয়েকটি জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাফুফের এই সিদ্ধান্তে। ফেডারেশন থেকে তালিকা প্রকাশ ও চিঠি না পাওয়ায় তারা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি, তবে তাদের প্রায় সবারই মতামতের সারমর্ম, ‘আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত হয়ে এখন আমাদের কমিটিই বাতিল করছে।’
বাফুফের গঠনতন্ত্র অনুসারে জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনকে বাৎসরিক একটি চাঁদা পরিশোদ করতে হবে (১০০০ টাকা)। অনেক জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশন সেই চাঁদাই পরিশোধ করেনি। যেকোনো সংগঠনে চাঁদা পরিশোধ না করলে ভোটাধিকার থাকে না। দীর্ঘদিন চাঁদা পরিশোধ না করেও অনেক জেলা-বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশন বাফুফের ভোটার হয়েছে ঠিকই। বাফুফে নির্বাহী কমিটির আদেশে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে সচিবালয়। এ নিয়ে বর্তমান কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তা যারা বিগত কমিটিতে ছিলেন, তারা মুখে কুলুপ এটেছেন। প্রকারান্তে দায় চাপাচ্ছেন সামগ্রিকভাবে নির্বাহী কমিটি এবং বিশেষত সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ওপর। কারণ ২০২০-২৪ এই মেয়াদে জেলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও ছিল তার।