রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী এলাকার যেই দোকানে বৃহস্পতিবার রাতেও ব্রয়লার মুরগির মাংস বিক্রি হয়েছে ১৯৫ টাকা কেজিতে, রাত পেরিয়ে ভোর হতে না হতেই একই দোকানে একই মুরগির মাংস বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। এভাবে প্রতি শুক্রবারই মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যেরই দাম বেড়ে যায়। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্রেতাদের চাহিদা বেশি থাকায় দাম বাড়িয়ে দেয় বাজার সিন্ডিকেট।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সকাল ও বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী এলাকার বাজার ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। তবে এ চিত্র শুধু রাজধানীর এই দুই এলাকারই নয়, পুরো ঢাকাতেই এমন বাজার চিত্র দেখা যায় বলে জানা গেছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় শুক্রবার এলেই মানুষের ধুম পড়ে মাছ-মাংস আর শাকসবজি কেনার। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও এখন একদিনেই সপ্তাহের বাজার করে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে চান।

তবে, শুক্রবারকেন্দ্রীক মানুষের এই চাহিদাকে ঘিরে ব্যবসায়ীরাও নিয়ে থাকে নানা কৌশল। প্রায় প্রতিটি পণ্যেরই দাম বেড়ে যায় কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। বাজার সরেজমিনে দেখা গেছে, শুক্রবারের বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়, যা বৃহস্পতিবার রাতেও ছিল ১৯৫-২০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত, যা একদিন আগেই বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা কেজিতে। এছাড়াও আজকের বাজারে সাদা লেয়ার ২৫০ টাকা ও লাল লেয়ার ৩০০ টাকায় এবং প্রতি কেজি সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকায়। এগুলোও রাতের ব্যবধানে অন্তত ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত কেজিপ্রতি বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।

মাছের বাজার ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। আজকের বাজারে রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত, যা একদিন আগেও দামদর করে ৩০০ টাকাতেই কিনতে পারা গেছে। এছাড়াও বাজারে আজ টেংরা ৫৫০, ছোট চিংড়ি ৫৫০, বড় চিংড়ি ৭০০ থেকে ৮০০, মলা মাছ ৪০০, শোল ৬০০, বোয়াল ৬০০, শিং ৩৫০-৪০০, বড় কাতল ৩০০, পোয়া মাছ ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এগুলোর প্রতিটি মাছই রাতের ব্যবধানে ৪০ থেকে ৫০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে গরু ও খাসির মাংসের বাজারেও দাম বৃদ্ধির এমন চিত্র দেখা গেছে। আজকের বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৭৮০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি খাসির মাংস ১০৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা ও ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকায়। এছাড়াও গরুর কলিজা ও খাসির কলিজা বিক্রি হচ্ছে মাংসের দামেই। শুক্রবারের বাজারে অন্যান্য দিনের তুলনায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ ক্রেতারা। তাদের দাবি, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে বাজারে ক্রেতাদের সবসময়ই এভাবে ঠকে যেতেই হবে। একইসঙ্গে বিক্রেতারাও সুযোগ নিয়ে আরও চড়াও হবে দামের ওপর।

ক্রেতারা বলছেন, শীতের সিজনেও আজকের বাজারে মাছ-মাংসসহ সবকিছুর দাম বেশি, অথচ এই দিনে যেহেতু বিক্রি বেশি, দাম তুলনামূলক কম থাকার কথা। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যেকারণে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। আর একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে, সেটা আর কমতে চায় না।

তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি দামে কিনে আনায় কম দামে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।

শরিফুল হাসান নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে সবকিছুরই দাম বেশি। মুরগির দামটা একটু কমেছিল, কিন্তু আজকে দেখলাম আবারও বেড়ে গেছে। এখন সবজির মৌসুম তারপরও সবজির দাম সেভাবে কম সেভাবে কমছে না।

আনিসুল হক নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ব্রয়লার মুরগির মাংস ২২০ টাকা কেজি, এটা একটু কমা দরকার। মাসখানেক আগেও ১৮০ টাকায় কিনেছি, এরপরই দাম বাড়তে শুরু করে। অথচ এই সময়ে কিন্তু খাদ্যের দামও বাড়তে শুনিনি। তার মানে দাম বাড়া-কমা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের ওপর।

তিনি আরও বলেন, নতুন সরকারের প্রতি আমাদের আশা ছিল জিনিসপত্রের দাম কমবে। কিন্তু সরকার এই জায়গাতে কিছুই করতে পারছে না। এক সময় বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে, এখন হাত বদল হয়ে আসছে অন্য দলের হাতে। মাঝখানে আমাদের সাধারণ মানুষের কিছুই হলো না। মুরগি ব্যবসায়ী মো. সুজন মিয়া বলেন, শুক্রবারে মুরগির দাম হালকা বাড়তি থাকে। আমাদের কিনেই আনতে হয় বেশি দামে। দামটা বাড়ে পাইকারি বাজারে, যেকারণে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ে। দাম বেশি থাকলে আমাদেরই বরং ক্ষতি, বিক্রিও কমে যায়। কম দাম থাকলে মানুষ কিনতে আসে বেশি।

ব্যবসায় মন্দা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অন্যান্য দিনে বেচাকেনার নাই বললেই চলে। শুক্রবারে কিছুটা হয়। মানুষের ইনকাম কম, খাবেই কী, পরবেই বা কী।

মাছ বিক্রেতা মোহাম্মদ শওকত মিয়া বলেন, গতকালে চেয় আজকের বাজার চড়া। কেজি প্রতি মাছের দাম ৪০/৫০ টাকা বেশি। সাধারণত প্রতি শুক্রবারেই একটু বেশি থাকে। তারপরও দাম নিয়ন্ত্রণেই আছে।

মুরগি মাংস বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, আমরা যে দাম বাড়িয়ে বেশি লাভ করি ব্যাপারটা এমন নয়। আমাদেরকেও কিনে আনতে হয়। যখন আমরা যেই দাম কিনে আনি, তারচেয়ে কয়েক টাকা লাভ রেখে আমরা বিক্রি করে দেই। এই ব্যবসা করে যে গাড়ি-বাড়ি করে ফেলেছি এমন নয়।

তিনি আরও বলেন, যখন দাম বেশি থাকে তখন বরং আমাদের বিক্রি কমে যায়। দাম কম থাকলেই মানুষ কিনে বেশি। তাছাড়া এই সময়ে দাম যে খুব বেশি তা নয়। শীতের সময়ে অনেক মুরগী মরে যায়, রোগবালাইও বেশি হয়। সে হিসেবে যেই দাম আছে, কমই বলা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *