আলজাজিরায় অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচারের পর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় খুঁজতে ব্রিটিশ আইনজীবীদের শরণাপন্ন হয়েছিল তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার। শুধু তাই নয়, সরকারের কুকীর্তি লুকানোর জন্যও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় সরকার। সানডে টাইমস।

২০২১ সালে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, তার পরিবার ও অন্যদের নিয়ে ওই প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করেছিল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি। এতে উঠে আসে কীভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপহরণ এবং অবৈধভাবে কোটি টাকা ঘুস নিয়েছেন তারা। শেখ হাসিনার আশকারায় কীভাবে দুর্নীতি হচ্ছিল সেটিও উঠে আসে ওই প্রামাণ্যচিত্রে।

প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচারের পর সংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা ব্যারিস্টার ডেসমন্ড ব্রাউনি কে সির কাছে গিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।

সম্প্রতি গণভবন থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমসের উদ্ধার করা একটি নথিতে ওই যোগাযোগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গণভবনে শেখ হাসিনার শোবার ঘরে জীর্ণ দশায় ছিল নথিটি।

ওই নথির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডেসমন্ড ব্রাউনির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে রাজিও হয়েছিলেন ব্রাউনি। এরপর তিনি হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরের কয়েক মাস ধরে দুজন শেখ হাসিনা সরকারকে নানা পরামর্শ দেন।

ওই প্রামাণ্যচিত্রটি মিথ্যা ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচারের পরপরই তাতে তথ্যদাতা জুলকারনাইন সায়ের খানের ভাইকে রড দিয়ে পেটানো হয়েছিল। এ ছাড়া প্রামাণ্যচিত্রটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে দেশত্যাগ করেছিলেন বা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

গণভবনে পাওয়া নথি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছিলেন ব্যারিস্টার ডেসমন্ড ব্রাউনি। সেখানে তার কথায় মনে হয়, ভবিষ্যতে আলজাজিরার বিরুদ্ধে তাদের হয়ে (হাইকমিশনের কর্মকর্তা) মামলা লড়তে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের আগে একজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার, যিনি তাকে (ব্যারিস্টার ব্রাউনি) পরামর্শ দেবেন। এরপর ব্রাউনির পরামর্শে লন্ডনের আইনি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান পেনিংটন মানচেস কুপারের বিশেষজ্ঞ জেরেমি ক্লার্ক-উইলিয়ামসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। কিছু দিন বাদে তিনিও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।

২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রতিনিধিরা ক্লার্ক-উইলিয়ামসকে বলেছিলেন, আলজাজিরার ওই প্রামাণ্যচিত্রে সারবত্তা তেমন কিছু না থাকলেও তা শেখ হাসিনার সুনাম ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। বাংলাদেশ সরকার বা সেনাবাহিনীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সেনাপ্রধানের মতো কোনো ব্যক্তি এই প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে আদালতে মানহানির মামলা করবে কিনা, সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা যিনি এই প্রামাণ্যচিত্রে নেই, তবে মনে করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে, তার মতো তৃতীয় কোনো পক্ষ মানহানির মামলা করবে কিনা, সে বিষয়েও পরামর্শ নিতে বলা হয়েছিল লন্ডন হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের।

নথির তথ্য অনুযায়ী, আলজাজিরার ওই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে কাজ করা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে গ্রেফতারের পরিকল্পনাও করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। ক্লার্ক-উইলিয়ামসকে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তারা বার্গম্যানের বিরুদ্ধেও মামলা করার জন্য প্রস্তুত।

ওই কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, Èরাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ওই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পেছনে ছিলেন ডেভিড বার্গম্যান। তাকে বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হবে।

বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের আদালতে মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর বিপরীতে তারা নিজেদের প্ল্যাটফর্ম থেকে আলজাজিরার প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য ফেসবুক ও ইউটিউবকে চাপ দেওয়ার প্রচষ্টো শুরু করেছিল। এ নিয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্টের রায়ের পরও প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে ফেলার বিষয়টি নাকচ করে দেয় দুই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এখনো প্রামাণ্যচিত্রটি ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখা যায়।

ডেসমন্ড ব্রাউনি সম্প্রতি আইন পেশা থেকে অবসরে গেছেন। তিনি সানডে টাইমসকে বলেন, এটা সত্যি যে, ১০ ফেব্রুয়ারি আমার সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর আমি ও ক্লার্ক-উইলিয়ামস (বাংলাদেশ) হাইকমিশনকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। তবে আমার জানামতে, ওই পরামর্শের পর আমি বা ক্লার্ক-উইলিয়ামস আর কোনো পদক্ষেপ নিইনি। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ক্লার্ক-উইলিয়ামস ও আমার দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী কোনো চিঠিপত্র দেওয়া বা মামলা মোকদ্দমা করা হয়নি।

ওই প্রতিবেদনের জেরে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ এবং তার ভাইদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *